পুরুষ নেই, শান্তি আছে: নারী শক্তির উদযাপনে বিশ্বের চোখে অনন্যা দেশের এই গ্রাম

যুদ্ধের দাপটে বিধ্বস্ত তাদের জীবন। অহরহ গুলির শব্দে আর চমকে ওঠে না তারা। আর সেই জীবনে তাদের প্রায়ই ক্রীতদাসীর ভূমিকা পালন করতে হয়। এমনটাই চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। এক দিকে যু-দ্ধের আবহে সর্বদা অনিশ্চিত জীবন, অন্য দিকে সেই জীবনে পুরুষতন্ত্রের নির্মম শোষণ। কিন্তু সব কিছুর শেষ আছে, সহ্যেরও। তাই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তাঁরাও। ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতে নিয়েছেন অস্ত্র। সমস্ত বাধা ছিন্ন করে পৃথক হয়েছেন নিজেদের খুশিতে। এবং সমাজের চোখে চোখ রেখে বলছেন, “আমাদের জীবনে পুরুষের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমাদের জীবন সুন্দর। নিজেদের মতো স্বাধীন ভাবে স্বচ্ছন্দ জীবন কাটাতে পারি আমরা।”

তাঁরা সিরিয়া সংলগ্ন এক ছোট্ট গ্রাম জিনওয়ারের বাসিন্দা। এবং তাঁরা সকলেই মহিলা। তাঁরা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছেন নিজেদের জীবন। নিজেদের সমাজ। নিজেদের চেষ্টায় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপায় করে, পুরুষদের গ্রাম ছাড়া করেছেন তাঁরা। তাঁদের প্রচেষ্টার মুখে গ্রামছাড়া হয়েছে যুদ্ধও। জিনওয়ার গ্রামের বাসিন্দা ২৮ বছরের তরুণী জায়নাব গাভারি বলছেন, “আমাদের গ্রাম শুধু সেই মেয়েদের জন্য, যারা সব কিছুর পরেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়।” এখানকার সব মহিলাই এই ভাবনায় বিশ্বাস করে। সারা বিশ্বের চোখে তুমুল প্রশংসিত হয়েছে এই ভাবনায় জারিত গ্রামটি। শক্তির আরাধনায় তাঁরা অনন্যা হয়ে উঠেছেন।

এক সময়ে এই গ্রামেই পুরোপুরি কোণঠাসা ছিল মেয়েরা। খুব ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় অনেকেরই পরিবার ছিল না। খুব কম বয়সেই অনেকে যুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছেন। দাসত্ব এবং হত্যাযজ্ঞ থেকে বেরিয়ে আসাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন তাঁরা নিজেদের ও সন্তানদের প্রতিপালনে সক্ষম। নিজের চাষ করেন, জমির যত্ন নেন এবং সেই ফসল বাজারে বিক্রি করে রোজগার করছেন। সেই উপার্জনের টাকায় চলছে সংসার। এ ছাড়াও পুরো গ্রামের সমাজ এবং অর্থনীতি সুচারু ভাবে পরিচালনার জন্য নিজেরাই ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নেই কোনও সাম্প্রদায়িক বিভাজন। এক রান্নাঘরের তৈরি খাবার সকলেই খান। ছোটদের জন্য স্কুল তৈরির পাশাপাশি বানিয়েছেন পোষ্যদের জন্য ক্রে-শও। মানবাধিকার শব্দটাকে তাঁরা নতুন করে ফিরিয়ে এনেছেন নিজের হাতে গড়া জীবনে, নিজেদের হাতে গড়া সমাজে।

শুধু তা-ই নয়। নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্বও তাঁরা নিজেরাই নিয়েছেন। গ্রামে ঢোকার মুখে বিশাল এক গেট তৈরি করেছেন তাঁরা। কিছু মেয়ে সেখানে ব-ন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকে পাহারায়। সে গেটের ভিতরে পুরুষ-প্রবেশ নিষেধ। নিজেদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে এবং শান্তি বজায় রাখতেই এমন সিদ্ধান্ত তাঁদের। ওই গ্রামের বাসিন্দা, গেটে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার কথায়, “পুরুষের প্রয়োজনই যেখানে ফুরিয়েছে, সেখানে তাঁদের ঢুকতে দিতে চাই না আমরা। তারা এত দিন অনেক অত্যাচার করেছে, মেরেছে। আর নয়। এবার বাঁচব।” 

এই গ্রামের মহিলারা প্রধানত কুর্দিশ সম্প্রদায়ের। স্থানীয় মহিলা ও আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাহায্য নিয়েই তৈরি হয়েছে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোমুক্ত এই গ্রাম। এখানকার বাড়ি, ছবি, শিল্প, গৃহসজ্জা সব কাজ একা হাতে মহিলারাই করেছেন। কৃষিকাজ থেকে স্কুলে পড়ানো সব কাজেই আজ পারদর্শী তাঁরা। কিন্তু আজ থেকে কিছু বছর আগেও তাঁদের এই গ্রাম ছিল আইসিসের অধীনে। যেখানে হাজার হাজার ইয়াদিদদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হতো রোজ। যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন অসংখ্য মহিলা। সেই কুর্দিশ নারীরাই এবার হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে।

তবে এই গ্রাম যে শুধু বিধবা বা ডিভোর্সি বা পুরুষের সঙ্গে থাকতে না চাওয়া মেয়েদের জন্যই নয়। এই গ্রাম এক কথায়, মেয়েদের মুক্ত ভাবে বাঁচার জন্য। ১৭ বছরের নাসরিন কাদির যেমন বলছেন, “পরিবার-পরিজনহীন একা বাঁচতে চাওয়ার এই লড়াইটা এক সময়ে কঠিন মনে হয়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে, আমি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাই। আত্মনির্ভরশীল হতে চাই। যেটা ওই সমাজ আমায় কখনও করতে দিক না। তাই এই বাঁচাটা আমার কাছে এক রকম জেদ।”

জিনওয়ার পেরোলেই শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার সীমানা। আইসিস জঙ্গিদের কালো পতাকা আর মুহূর্মুহু গ্রেনেডের হুঙ্কারে কার্যত শ্ম-শান হয়ে দাঁড়িয়েছে ছোট্টদেশটি। এর মধ্যেই একদল মহিলা নিজেদের নিয়ে তৈরি করেছে সুরক্ষিত এই গ্রাম। ওই গ্রামের প্রায় প্রত্যেক মহিলার জীবনেই রয়েছে এক একটি মর্মা-ন্তিক ঘটনা। কেউ আইসিস জ-ঙ্গিদের হাতে দীর্ঘদিন যৌনদাসী হয়ে বর্বরোচিত অ-ত্যাচা-রের মুখোমুখি হয়েছেন। কারও স্বামীকে খু-ন করা হয়েছে। কেউ বা জঙ্গি হামলায় সন্তান-স্বামী খুইয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়েছেন। কেউ বা দিনের পর দিন ধ-র্ষণ হয়ে সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন। যাঁর জীবনের ঘটনা যা-ই হোক না কেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে তাঁরা সকলেই অত্যাচারিত এবং অবহেলিত, আজ নির্দ্বিধায় বলছেন ওই গ্রামের মহিলারা।

যু-দ্ধে স্বামীকে হারিয়ে এই গ্রামে এসে থাকছেন বছর আটত্রিশের আমিরা মহম্মদ। বললেন, “যত দিন না নারীরা শিক্ষিত হচ্ছেন, স্বনির্ভর হচ্ছেন এই সমাজও কখনও স্বাধীন হতে পারবে না। তাই আমরা নিজেরাই ফসল ফলাই, সেই ফসল রফতানিও করি। আবার সন্তান পালনও করি।”পুরুষবিহীন এই ছোট্ট গ্রামই যেন বাশার-অল আসাদের যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার ‘শান্তির রাজধানী’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button