নতুন মৌসুমের আগে লবণ আমদানির ছায়া
“চাষিদের দাবি: বন্ধ হোক আমদানি, নিশ্চিত হোক ন্যায্যমূল্য….
কক্সবাজার উপকূলে লবণ চাষ একসময় ছিল গর্বের পেশা, আজ তা চাষিদের ঘরে ঘরে বয়ে আনছে নীরব কান্না। দাম নেই, ক্রেতা নেই-মাঠে পড়ে আছে ৮-১০ লাখ মেট্রিক টন লবণ। চাষিদের দাবি, সামনে নভেম্বরে শুরু হবে নতুন মৌসুম, অথচ এর আগেই লবণ আমদানির পায়তারা করছে একটি চক্র। যদিও বিসিক বলছে, চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে সরকার।
বিসিকের তথ্যনুযায়ী, কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৬৯ হাজার একর জমিতে ৪১ হাজারের বেশি চাষি লবণ উৎপাদনে নিয়োজিত। ২০২৪-২৫ মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। অর্জন হয় ২২ লাখ ৫১ হাজার টন, যা ৬৫ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে একসময় লবণচাষ ছিল গর্বের পেশা। সূর্যের তাপে সাদা সোনা ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন হাজারো মানুষ। কিন্তু আজ সেই লবণই যেন হয়ে উঠেছে বোঝা। ঘরে ঘরে লবণচাষিদের বয়ে আনছে নীরব কান্না।
মহেশখালীর লবণ চাষি জয়নাল আবেদীন বলেন, “বর্তমানে প্রতিমণ লবণের দাম ১৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। অথচ উৎপাদন খরচ পড়ছে তিনশ টাকারও বেশি। ৩ কানি জমিতে (প্রায় ১.২০ একর) চাষ করতে খরচ হয় গড়ে আড়াই লাখ টাকা- জমি ইজারা, পলিথিন, শ্রমিক মজুরি, লবণ মাঠ প্রস্তুতসহ। বিক্রির আয় দিয়ে সেই খরচও উঠছে না। লোকসানের বোঝা বইতে বইতে আর পারছি না।
এদিকে সম্প্রতি ‘লবণ উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদ’ মহেশখালীতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। এ সময় তারা তাদের উৎপাদিত লবণ সড়কে ফেলে প্রতীকী প্রতিবাদ জানায়।
চাষিরা দাবি করেন- বিদেশি লবণ আমদানি বন্ধ করতে হবে, লবণের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করতে হবে এবং দ্রুত জাতীয় লবণ বোর্ড গঠন করে শিল্পকে রক্ষা করতে হবে।
লবণ উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপকূলে লবণচাষিদের দুর্দশা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, দেশে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হলেও চাষিরা আজও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। একদিকে জমি ইজারার অস্বাভাবিক খরচ, অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের অপ্রাপ্যতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
তিনি বিসিকের কার্যক্রম নিয়েও সমালোচনা করে বলেন, “বিসিক থাকার পরও প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত চাষিদের চেয়ে শিল্প মালিক ও একটি মাফিয়া গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় বেশি সক্রিয়। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লবণচাষিদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
শহিদুল্লাহ বলেন, দেশে লবণের চাহিদা মেটানোর মতো উৎপাদন হচ্ছে। তাই বিদেশ থেকে লবণ আমদানির কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং সরকারের উচিত-চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা এবং আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার সুযোগ নিশ্চিত করা।
তিনি আরও বলেন,লবণশিল্প শুধু একটি খাত নয়-এটি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবিকার অবলম্বন। লবণশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারলেই এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা পাবে।
চাষিদের দাবি, মাঠ ও গুদামে পড়ে আছে ৮ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন অবিক্রিত লবণ। অথচ বিসিকের হিসেবে মজুদের পরিমাণ মাত্র ৫ লাখ টন। এই গড়মিলে প্রশ্ন উঠছে-চক্র বিশেষ কি পরিকল্পিতভাবে লবণ আমদানি করতে চাইছে?
বাংলাদেশ সল্টেড অ্যান্ড ডিহাইড্রেটেড ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল শুক্কুর বলেন, বর্তমানে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় চলছে। আগামী নভেম্বরেই শুরু হবে নতুন মৌসুমের লবণ উৎপাদন। অথচ এ অবস্থায় এখনও মাঠ পর্যায়ে গর্ত ও গুদামে চাষিদের কাছে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুদ রয়েছে।
তিনি বলেন, চাষিরা এই লবণ বিক্রি করতে পারছেন না, কারণ বাজারে দাম অত্যন্ত কম। এই পরিস্থিতিতে যদি সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে লবণ আমদানির অনুমতি দেয়, তাহলে দেশের লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।”
আব্দুল শুক্কুর অভিযোগ করেন, “ঢাকায় কিছু অসাধু লবণ আমদানিকারক রয়েছে, যারা কক্সবাজারের কয়েকজন লোককে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)-কে ভুল তথ্য দিচ্ছে। এসব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সচিবালয়ে বিভ্রান্তিকর জরিপ উপস্থাপন করে লবণ আমদানির অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের অপচেষ্টা রুখে না দিলে দেশের লবণচাষিরা উৎপাদনে আগ্রহ হারাবে। তারা মাঠ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, যার ফলে দেশের স্বনির্ভর লবণ শিল্প চরম হুমকির মুখে পড়বে।
তবে বিসিক বলছে, মজুদের রিপোর্টে কোনো গড়মিল নেই। সরকার কাজ করছে চাষিদের স্বার্থ রক্ষায়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, দেশের লবণ উৎপাদন মৌসুম মূলত নভেম্বর থেকে শুরু হলেও কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলায় অক্টোবর থেকেই মাঠে নামেন লবণচাষিরা। বর্তমানে কুতুবদিয়ায় কিছু চাষি মাঠ প্রস্তুতের কাজে ব্যস্ত। তিনি আশা প্রকাশ করেন, কক্সবাজার উপকূলের অন্যান্য এলাকাগুলোতেও নভেম্বরের শুরুতে চাষিরা মাঠে নেমে পড়বেন।
তিনি বলেন বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে প্রতি মণ লবণ ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ মুহূর্তে মাঠে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুদ রয়েছে। লবণ আমদানি সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত। জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি রয়েছে, যারা সার্বিক দিক বিবেচনা করেই আমদানির প্রয়োজন আছে কিনা তা নির্ধারণ করেন।”
লবণ মজুদের বিষয়ে তিনি বলেন, “বিসিক মাঠ পর্যায়ে চাষিদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা তৈরি করে—কার কাছে কত লবণ রয়েছে, তা আমরা নির্ভুলভাবে নথিভুক্ত করি। আমাদের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ৫ লাখ মেট্রিক টনের মতো লবণ মজুদ রয়েছে। কেউ কেউ ৮-১০ লাখ মেট্রিক টনের কথা বলছেন, তবে সেই তথ্য সঠিক নয়।
আমদানির ফলে চাষিরা লবণ উৎপাদনে আগ্রহ হারাতে পারেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, যদি এ সময় আমদানি করা হয়, তাহলে চাষিদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হবে এবং তারা মাঠে নামতে আগ্রহ হারাতে পারেন। তবে সরকার এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। বৈঠকগুলোতে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনায় আসছে, যাতে চাষিরা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
তিনি আরও বলেন, “চাষিদের যেন ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতভাবে পাওয়া যায়, সেজন্য আমরা সব ধরনের চেষ্টা করছি। সরকার চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বাত্মকভাবে কাজ করছে।
আগামী নভেম্বরে শুরু হচ্ছে নতুন মৌসুম। লক্ষ্যমাত্রা ২৬ লাখ ১৮ হাজার টন। কিন্তু পুরনো লবণের বাজারজাত না হলে নতুন লবণের ভবিষ্যত নিয়েও দুশ্চিন্তায় চাষিরা।