মোঃ সোহরাব হোসাইন
হেমন্ত সকালের শুভ্র-নীল আকাশ। সাদা তুলার মতো কিছু মেঘের ছোটাছুটি আকাশজুড়ে। সকাল সকাল খুব বেশি রোদের তীব্রতা নেই। শহরের সড়ক গুলোও অনেকটা ফাঁকা। শুক্রবার ছুটি, তাই অফিসগামী মানুষের আনাগোনাও নেই। সড়কে মানুষের চলাচল না থাকলেও হাতে ফলের ছোট ছোট প্যাকেট নিয়ে ঠিকই বের হয়েছেন ছোট ছোট শিশু ফেরিওয়ালা (হকার)।
চট্টগ্রাম চাক্তাই নতুন ব্রিজ নগরের শাহ আমানত রোড মার্সা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এই শিশু ফেরিওয়ালা (হকার)। সঙ্গে কিছু ফলের ঝুড়ি। ছেঁড়া শার্ট প্যান্ট কাপড় পরে দাঁড়িয়ে থাকা এই ফেরিওয়ালা শিশু (হকার) গুলো।
অবহেলা বেরে উঠা রিজিকের সন্ধ্যানে অলস ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ফেরিওয়ালা এই শিশু গুলো, যেন কোনো কিছুর অপেক্ষা করছেন। ঝুড়িতে কী, এমন প্রশ্ন করতেই নড়েচড়ে ওঠেন এক শিশু ফেরিওয়ালা (হকার)। একটা হাসি দিয়ে বলেন—‘চিপস’। কী চিপস, কোথা থেকে এনেছেন—প্রশ্ন করতেই উত্তর দিতে থাকেন এই শিশু ফেরিওয়ালা। কথায় কথায় আলাপ জমে।
রেদোয়ান বয়স ১২ বছর। চাক্তাই নতুন ব্রিজ শহরের রাস্তায় রাস্তায় গাড়িতে উঠে ফেরি করে বিভিন্ন ধরনের ফল, তেলে ভাজা চিপস, পাঁপড়, বাদামসহ বিভিন্ন শুকনা খাবার বিক্রি করেন। সকাল আটটা থেকে ফেরি করার জন্য বেরিয়েছেন। ফাঁকা রাস্তায় ২০ মিনিটের মতো সময় লেগেছে গাড়ি আসতে। কিন্তু যাদের জন্য রেদোয়ান ওই বিক্রির আয়োজন, তারা এত সকালে ঘুম থেকে উঠেনি। এখন গাড়ি না আসলে কিছু বিক্রি হবে না, বরং আওয়াজ শুনে মানুষ বিরক্ত হবেন। তাই সেখানে দাঁড়িয়ে সময় পার করছিলেন রেদোয়ান।
রেদোয়ানের ঝুড়িতে আছে ছোট ছোট প্যাকেট করা কমলা, মাল্টা, ও চিপস ও নানা কিছু। প্রতি প্যাকেটের মূল্য ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করে প্যাকেটগুলো করা হয়েছে।
রেদোয়ান বলেন, দিনে কখনো কখনো বেশ ভালো বিক্রি হয়, আবার কোনো দিন একেবারেই হয় না। আবার দেখা যায়, কোনো কোনো গাড়িতেই একবারে এক থেকে দেড় হাজার টাকার মালামাল বিক্রি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তাঁর বাড়ি কক্সবাজার মহিষখালি গ্রামে। বাড়িতে তাঁর মা আছেন। এক ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রেদোয়ান। বড় বোন শশুর বাড়ি থাকেন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। প্রতিদিন মায়ের জন্য এই ফেরি করে রিজিক সন্ধ্যান করে।
রেদোয়ান বলেন, তিনি যখন অনেক ছোট, তখন তাঁর বাবা চট্টগ্রাম এসে এভাবে ফেরি করে বিভিন্ন কিছু বিক্রি করতেন। প্রায় এক মাস ফেরি করার পর মাস শেষে বাড়িতে চলে যেতেন। বাবার এভাবে ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করার টাকাতেই তাঁদের সংসার চলত। এখন বাবা নেই তাই অভাবের সংসারে শিশু ফেরিওয়ালা রেদওয়ানের পড়াশোনা করতে পারেনি। ৩ বছর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে চট্টগ্রাম আসতে শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে ব্যবসাটা শিখে নিয়েছেন। বাবা মারা গেছেন কয়েক বছর হলো। এখন তিনি ওই ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন। বিভিন্ন ধরনের ফল বিক্রি করে।
রেদোয়ান যেখানে থাকেন, সেটি একটি মেস। তাঁর মতো আরও কয়েক ফেরিওয়ালা সেখানে ভাড়া থাকেন। রান্নার সময় নেই, তিন বেলাতেই খেতে হয় হোটেলে। টিনের ছোট একটি ঘরে ভাড়া থাকেন। সকালে ফেরি করার জন্য বের হন। চট্টগ্রাম চাক্তাই নতুন ব্রিজ মার্সা কাউন্টারের সামনে গাড়ি গাড়ি বিক্রি করেন। বিকেলে চলে যান শহরের বড় বাজার এলাকায়। সেখান থেকে পাইকারি দামে আবার মালামাল কিনে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন। গভীর রাত পর্যন্ত সেগুলো মেপে ছোট ছোট প্যাকেট করে ঘুমাতে যান। সকাল হলেই আবার বেরিয়ে পড়েন। এভাবেই কেটে যায় দিন। দিন শেষ ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা লাভ থাকে। আগে বিভিন্ন কিছু বিক্রি করে খুব বেশি লাভ হতো না। মানুষ কম কিনতেন। এ কারণে সেটি বাদ দিয়ে এখন ফল, পাঁপড়, চিপসসহ বিভিন্ন শুকনা খাবার বিক্রি করছেন। এতে যে টাকা আয় হয়, সব জমা করেন। মাসে একবার বাড়িতে গিয়ে কয়েক দিন থাকেন। তখন সংসারের খরচের টাকা দেন।
রেদোয়ান বলেন, এ ব্যবসা করে যে আয় হয়, তা দিয়ে সংসার কোনো রকমে চলে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে তিনি চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাচ্ছেন। খুব বেশি ভালো খাবার খেতে পারেন না, তবে যা আয় হয়, তা দিয়েই জীবনটা চালিয়ে নিতে হয়।
এই ভাবে চলছে এই শহরের রাস্তা ফেরিওয়ালা (হকার) দের। তাদের কষ্টের ভাগ কেউ নিতে পাশে আসে না এই শিশু ফেরিওয়ালা হকারদের। আমরা অনেকেই চাইলে তাদের পাশে দাঁড়িতে পারি। হয়তো এই ছোট্ট শিশু হকার একদিন অনেক বড় হতে পারবে একটু সহযোগিতা ফেলে।